কবি আসাদ মান্নান

এক সহজাত কবিপ্রতিভার অধিকারী সত্তর দশকের অন্যতম প্রধান কবি আসাদ মান্নান। বাংলা কবিতার মৌলিক বিষয় ও ভাবনায় তিনি জন্মসূত্রে পাঠক ও সমালোচক মহলে সমুদ্রের কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত ও খ্যাতিমান। তার কবিতার মর্মমূলে নদী ও সমুদ্রের সঙ্গে চিরকালীন নারী ও নিসর্গের এক অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে, যা বাংলা কবিতার শক্তি ও সম্ভাবনাকে ভিন্ন মাত্রায় প্রসারিত করেছে। আর এ জন্য তিনি সমকালীন সময়ে তো বটে চিরকালীন বাংলা কবিতায় স্বতন্ত্রস্বরের কবি কবি হিসেবে নন্দিত। বরেণ্য কবি-সমালোচককের ভাষায় ‘আসাদ মান্নান’ প্রকৃত প্রেমের কবি।’ কিন্তু তার কবিতায় নারী-পুরুষের প্রথাগত প্রেমের অনুরণন কোথাও অনুভূত হয় না ; বরং প্রেমময় এক জীবনতৃষ্ণার অফুরন্ত আকাক্সক্ষা গভীর এক রহস্যময়তায় উন্মোচিত হতে দেখা যায়। তিনি মা-মাটি ও মাতৃভূমির বেদনাকে নিসর্গের ক্যানভাসে বিচিত্র রঙ ও রেখায় একজন নিপুণ শিল্পীর অসামান্য কল্পনায় অঙ্কন করেছেন বহুমাত্রিক শব্দচিত্রে। কবি শামসুর রাহমান যাকে তারিফ করেছেন, ‘কলমচিত্রকর’ বলে। বলা যায়, এ ক্ষেত্রে তিনি সমসাময়িক কবিদেরও ছাড়িয়ে গেছেন অবলীলায়।
মধ্য-সত্তর থেকে স্কুল জীবনে কবিতা লেখার হাতে খড়ি হলেও মূলত ১৯৭৩ সাল থেকে লেখালেখির জগতে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘ সহসা আগুন জ¦লে যমুনার জলে’ রচনা কাল ১৬ আগস্ট ১৯৭৬। প্রথম সম্পন্ন কবিতা লিখেন ১৯৭৬ সালে আগস্ট মাসে। কবিতার নাম – ‘ সবুজ রমণী এক দুঃখিনী বাংলা”। এ কবিতা দিয়ে মূলত বাংলা কবিতায় তার উজ্জ¦ল যাত্রা শুরু, এখনও চলমান রয়েছে।
আসাদ মান্নান তার কবিজীবনের সূচনালগ্ন থেকেই সহজাত প্রতিভার সঙ্গে প্রজ্ঞার, মেধার সঙ্গে অনুভূতির আশ্চর্য সমন্বয় ঘটিয়েছেন। স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নির্মানের সঙ্গে ধারণ করেছেন ছন্দ ও আঙ্গিক প্রকরণের ঐতিহ্যকে। এক কথায়, আসাদ মান্নানের কবিতা ছন্দনৈপুণ্যে অসামান্য এবং গভীরতায় অসাধারণ চিত্রময়। তার প্রতিটি কাব্যগ্রন্থের প্রায় প্রতিটি কবিতার চরণে চরণে আসাদ তার সম্মোহনী কবিশক্তির পরিচয় দিয়েছেন, যা পাঠকের মনে এক ধরনের নন্দন-আনন্দবোধের জাগরণ সৃষ্টি করে এবং প্রত্যেক কবিতার প্রায় প্রতিচরণে তিনি খুঁজে বেড়িয়েছেন এমন সব মুগ্ধতাশ্রয়ী চিত্রকল্প যার ফাঁদে আটকা পরে রসভোক্তার চিত্ত। আসাদ মান্নানের কবিতার সবচেয়ে বড় গুণ শৈল্পিক কল্পনা। এমন কি যখন তিনি প্রবল রাজনৈতিক বক্তব্য কবিতায় তুলে ধরেন তখনও তা গভীর রহস্যময় কাব্যকৃতিকে ছুঁয়ে থাকে। তার কবিতা দাবি কওে পাঠকের গভীর অভিনিবেশ।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সসহ ¯œাতকোত্তর কবি আসাদ মান্নানের জন্ম ১৯৫৭ সালের ৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলার সাতঘরিয়া গ্রামে।
পেশাগত জীবনে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন সদস্য হিসেবে জনাব আবদুল মান্নান ( কলমি নাম আসাদ মান্নান ) রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। মাঠ পর্যায়ে সহকারী কমিশনার ও ম্যাজিস্ট্রেট, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন; অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব/সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব,যুগ্ম-সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে। সুনামের সঙ্গে প্রায় দু’বছর ধরে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। সবশেষে সচিব হিসেবে তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য পদে দায়িত্ব পালনের পর সিভিল সার্ভিস থেকে অবসর গ্রহণ করেন ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসের ২ তারিখে।
বর্তমানে কবি আসাদ মান্নান ( আবদুল মান্নান) একটি সাংবিধানিক পদে বাংলাদেশ পাবিলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য হিসেবে বিগত ২৪ জুন ২০১৮ তারিখ থেকে কর্মরত আছেন।
ব্যক্তিজীবনে কবি আসাদ মান্নান বিবাহিত । তার স্ত্রী নাজমা মান্নান গৃহিণী হলেও তিনি একজন সংগীত শিল্পী, যিনি বেতার ও টেলিভিশনে গান করে থাকে। তাদের ২ সন্তান কুহু মান্নান ও মাথুর মান্নান। শৈশব থেকে গান-বাজনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত আছে। দুজনেই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে একাধিকবার গান পরিবেশন করেছে। দুজনেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করেছে – কুহু জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ¯œাতক অনার্সসহ ¯œাতকোত্তর এবং মাথুর চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় ফাইন্যান্স বিষয়ে অনুরূপ ডিগ্রী লাভ করেছে। কুহু বিবাহিত এবং একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘জাইকা’-তে কাজ করছে দক্ষতার সঙ্গে। মাথুর এখনও কর্মজীবনে প্রবেশ করেনি।
আসাদ মান্নানের উল্লে¬খযোগ্য কাব্যগ্রন্থ:-
১। ‘সুন্দর দক্ষিণে থাকে’; ২। ‘সূর্যাস্তের উল্টোদিকে’; ৩। ‘সৈয়দ বংশের ফুল’; ৪। ‘ভালোবাসা আগুনের নদী’; ৫। ‘দ্বিতীয় জন্মের দিকে’; ৬। ‘তোমার কীর্তন’; ৭। ‘যে-পারে পার নেই সে-পারে ফিরবে নদী’; ৮। ‘নির্বাচিত কবিতা’; ৯। ‘প্রেমের কবিতা’; ১০। ‘হে অন্ধ জলের রাজা’ ; ১১। ‘জলের সানাই ;’ ১২। পাথর সে কী করে কাঁদে’ ১৩। কুয়াশা উপেক্ষা করে বসে আছে আশা’ ইত্যাদি।
সম্মাননা ও স্বীকৃতি: ১.বাংলাদেশ পরিষদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৭,১৯৭৮); ২. কর্ণফুলী সাহিত্য পদক; ৩. জীবনানন্দ পদক ও পুরস্কার; ৪. কবিতালাপ পুরস্কার, ৫. রাজশাহী সাহিত্য পরিষদ পদক ও সম্মাননা; ৬. কবিকুঞ্জ পুরস্কার ও সম্মাননা; ৭. পুনশ্চ পদক; ৮. মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ সাহিত্য পুরস্কার ৯. খড়িমাটি সন্মাননা ইত্যাদি।

Showing all 3 results

Show sidebar