মিনার মনসুর : বঙ্গবন্ধু-হত্যাপরবর্তী প্রতিবাদী সাহিত্যধারার পুরোধা ব্যক্তিত্ব

মিনার মনসুর একজন শক্তিশালী লেখকের নাম। মূলত প্রেম ও দ্রোহের কবি হিসেবে খ্যাতিমান হলেও একজন প্রাবন্ধিক, গবেষক, শিল্প-সমালোচক, ছড়াসাহিত্যিক, সম্পাদক হিসেবেও তাঁর পরিচিতি পরিব্যাপ্ত। তিনি বঙ্গবন্ধু-হত্যাপরবর্তী প্রতিবাদী সাহিত্যধারার পুরোধা ব্যক্তিত্ব। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম মাইলফলক স্মারকগ্রন্থ ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ সম্পাদনা করেছেন ১৯৭৯ সালে। বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৭৮ সালে প্রকাশ করেছেন ‘এপিটাফ’। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ‘আবার যুদ্ধে যাবো’ শিরোনামে একটি বিশেষ বুলেটিন প্রকাশ করেছেন ১৯৮০ সালে। এতে পঁচাত্তরের ঘৃণ্য হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবাদী কবিতা রচনায় তিনি অনন্য। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে’ বাজেয়াপ্ত হয়েছে ১৯৮৩ সালে। লিখেছিলেন :
‘মোল্লা মওলানা সর্বাঙ্গে পেচ্ছাব করে আমি স্বর্গে যাবো।
কোথায় যাবো! স্বর্গে যাবো।’

লিখেছিলেন :
‘মুতে দে কিশোর, মুতে দে
এ সমাজ সভ্যতা ভরে তুই মুতে দে’।

অনেকগুলো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। তন্মধ্যে রয়েছে : এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে, কবিতাসংগ্রহ, মা এখন থেমে যাওয়া নদী, মিনার মনসুরের দ্রোহের কবিতা, মিনার মনসুরের প্রেমের কবিতা, পা পা করে তোমার দিকেই যাচ্ছি, নির্বাচিত কবিতা, আমার আজব ঘোড়া, নির্বাচিত ১০০ কবিতা, অতল জলের টানে, হেলাফেলার ছড়া, চিরকালের নেতা, হাসান হাফিজুর রহমান: বিমুখ প্রান্তরে নিঃসঙ্গ বাতিঘর, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত: জীবন ও কর্ম, শোষণমুক্তির সংগ্রামে মধ্যবিত্তের ভূমিকা, কবি ও কবিতার সংগ্রাম, আমার পিতা নয় পিতার অধিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শত্রুমিত্র, বঙ্গবন্ধু কেন দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, জলপাইরঙের একটি হেলমেট আর এক জোড়া বুট, শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা, মুক্তিযুদ্ধের উপেক্ষিত বীর যোদ্ধারা প্রভৃতি।
লেখকদের সবসময় আদর্শবাদী হতে হয়। মিনার মনসুরের আদর্শ হলেন বঙ্গবন্ধু। এক্ষেত্রে তিনি আপসহীন নীতিবোধসম্পন্ন দৃঢ়চিত্তের মানুষ। স্বদেশপ্রেম, মানুষের জন্য দায়বোধ ও সৎ জীবনযাপনে নিবেদিতপ্রাণ মিনার মনসুর জীবনে অনেক কিছু ত্যাগ করেছেন। নানা দিক ওঠে আসে তাঁর কবিতা ও অন্যান্য রচনায়। বলা যায়, ইতিহাস-দর্শন, সমাজ-সভ্যতা, কাল-মহাকাল সব একাকার হয়ে যায়। ব্যক্তি মিনার মনসুর আর লেখক মিনার মনসুরের মধ্যে পাওয়া যায় অনন্য এক মমত্ববোধ।
সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘকাল। দৈনিক ‘সংবাদ’এর সহকারী সম্পাদক ছিলেন। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ কাজ করেছেন দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক ও সম্পাদকীয় বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে। বর্তমানে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক।
সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্যে ‘শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতিপদক’ সহ পেয়েছেন বেশকিছু স্বীকৃতি ও সম্মাননা।


মিনার মনসুরের জন্ম ২০ জুলাই ১৯৬০ সালেÑ চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার বরলিয়া গ্রামে। বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রাম শহরে। লেখাপড়া করেছেন চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি উচ্চমাধ্যমিক কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্র রাজনীতি ও লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সক্রিয়ভাবে। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত চাকসুর অমর একুশের প্রকাশনা ‘অবরুদ্ধ মানচিত্রে’ জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করে। জাতীয় সাপ্তাহিক ‘দেশবন্ধ’ু পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবনের শুরু। ইউএসএআইডির অর্থায়নে প্রকাশিত উন্নয়ন বিষয়ক মাসিক ‘প্রজন্ম’ এবং এনজিওদের শীর্ষ সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান ‘এডাব’ থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘অধুনা’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন দেশিবিদেশি বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে। দৈনিক সংবাদে ‘অনির্বাণ বাতিঘর’ শিরোনামে এবং দৈনিক ইত্তেফাকে ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ শিরোনামে কলাম লিখেছেন দীর্ঘদিন।
জাতীয় কবিতা পরিষদ ও বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। জাতীয় প্রেসক্লাবের স্থায়ী সদস্য এবং বাংলা একাডেমি ও এশিয়াটিক সোসাইটির জীবন সদস্য।
পেশাগত কারণে আমেরিকা, চীন, জার্মানি, ব্রিটেন, ভারত, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও নেপাল ভ্রমণ করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে এক কন্যা (আলোকিতা তাহমিন মনসুর) এবং এক পুত্র (অদম্য স্বাপ্নিক মনসুর) সন্তানের জনক।

উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ

কবিতা:
এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে (১৯৮৩, বাজেয়াপ্ত);
কবিতাসংগ্রহ (২০০১)
মা এখন থেমে যাওয়া নদী (২০১২)
মিনার মনসুরের দ্রোহের কবিতা (২০১৩)
মিনার মনসুরের প্রেমের কবিতা (২০১৩)
পা পা করে তোমার দিকেই যাচ্ছি (কলকাতা, ২০১৬)
নির্বাচিত কবিতা (২০১৬)
আমার আজব ঘোড়া (২০১৯)
নির্বাচিত ১০০ কবিতা (২০২০)

গল্প:
অতল জলের টানে (২০১৭)

ছড়া:
হেলাফেলার ছড়া (১৯৮৯)
চিরকালের নেতা (২০২০)

গবেষণা:
হাসান হাফিজুর রহমান: বিমুখ প্রান্তরে নিঃসঙ্গ বাতিঘর (বাংলা একাডেমি, ১৯৯৯)
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত: জীবন ও কর্ম (বাংলা একাডেমি, ২০১২)।

প্রবন্ধ:
শোষণমুক্তির সংগ্রামে মধ্যবিত্তের ভূমিকা (১৯৮৭)
কবি ও কবিতার সংগ্রাম (২০১৩);
আমার পিতা নয় পিতার অধিক (২০১৯)
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শত্রুমিত্র (২০১৯)
বঙ্গবন্ধু কেন দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন (২০২০)

জীবনী:
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (বাংলা একাডেমি, ১৯৯৭)

কিশোর গল্পগ্রন্থ:
জলপাইরঙের একটি হেলমেট আর এক জোড়া বুট (২০১৮)

সম্পাদিত গ্রন্থ
শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ (প্রথম প্রকাশ: ১৯৭৯; বাংলা একাডেমি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পরিমার্জিত প্রকাশ: ২০২০)
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থ ( যৌথ, ১৯৯৪);
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা (যৌথ, ১৯৯৫);
মুক্তিযুদ্ধের উপেক্ষিত বীর যোদ্ধারা (২০০৮);
বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও উন্নয়ন: বিশিষ্টজনের ভাবনা (২০১০)
সিকদার আমিনুল হক রচনাসমগ্র (২০১৫)
তারুণ্যের চোখে বঙ্গবন্ধু (২০২০)
শোষিতের বন্ধু বঙ্গবন্ধু (২০২০)

….

‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ এখন ইতিহাসের অংশ। প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। আমরা তখন সবেমাত্র কলেজের গ-ি পার হয়েছি। টগবগ করে ফুটছি ক্রোধে। অস্ত্র হাতে খুনিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার মতো অবস্থা তখন ছিল না। পর্বতপ্রমাণ সেই অসহায়তার ভার থেকে খানিকটা মুক্ত হওয়ার অভিপ্রায় থেকেই আমরা কলমকেই হাতিয়ার বানাতে চেয়েছিলাম। পরিকল্পনা ছিল বিশ্বের মুক্তিকামী নেতাদের সাক্ষাৎকার/প্রতিক্রিয়াগুলো জড়ো করে একটি গ্রন্থ প্রকাশের । বিশিষ্ট কবি ও বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন ও বাস্তবায়ন কমিটির মূল সমন্বয়ক কধসধষ ঈযড়ফিযঁৎু ও যুক্ত ছিলেন আমাদের এই আকাশচুম্বী পরিকল্পনার সঙ্গে। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত যা হলো–সেটা আজ অবধি, আমার জানা মতে, বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকা-ের পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রথম সংকলন

….
সকল বিচারেই আকর্ষণীয় একটি প্রকাশনা।কিন্তু কপাল মন্দ! কপাল ভালো করতে হলে, এখন এই রুদ্ধশ্বাস বই ও মানুষের ভিড়ে যে উচ্চকিত প্রচার দরকার তার ছিটেফোঁটাও জোটেনি বইটির ভাগ্যে। আর এমনিতেই আমার সমগ্র লেখকজীবনে আমি কখনো বইয়ের প্রকাশনা উৎসব, মোড়ক উন্মোচন– এসব করেছি বলে মনে পড়ে না।তবে এখনকার প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন।

একদিকে মেলায় হাজার হাজার বইয়ের সমারোহ, অন্যদিকে মানুষের জীবন থেকে ‘অবকাশ’ নামক শব্দটি উবে গেছে, ফলে প্রচারের কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু কে করবে? আমার তো দম ফেলবারও ফুরসত মিলছে না।প্রকাশকদেরও দোষ দিয়ে লাভ নেই। তাদের অবস্থা আরও খারাপ।একটা কিছু উপায় খুঁজে বের করা না গেলেও বই যত ভালোই হোক, এ যুগে তা পাঠকের কাছে পৌঁছানো মোটেও সহজ নয়।

আগ্রহী পাঠক–যারা আমার ‘নির্বাচিত ১০০ কবিতা’ কিনতে চান তাদের জন্যে দরকারি কয়েকটি তথ্য: বইটির প্রকাশক: অন্যপ্রকাশ, প্রচ্ছদ করেছেন:মাসুম রহমান; দাম: ৩৫০ টাকা। পাবেন: বইমেলায় অন্যপ্রকাশের প্যাভিলিয়নে।

Showing all 6 results

Show sidebar