সেলিনা শেলী : প্রজ্ঞা, মেধা ও সৃজনশীলতাই যাঁর প্রধান ভিত্তি
সেলিনা শেলী। দেশের একজন মেধাবী কবি। গল্পকার এবং প্রাবন্ধিক হিসেবেও তাঁর রয়েছে সমান পরিচিতি ও খ্যাতি। বলা হয়ে থাকে, কবিতায় যাঁরা একার সন্ন্যাস যাপন করেন উত্তমরূপে, তাঁদেরই একজন তিনি। ‘অনিশ্চিত মধ্যবিত্ত জীবনের নানামাত্রিক অভিঘাতে’ দগ্ধ এই কবি সাহিত্য যাপন করেন পরিচ্ছন্ন শুদ্ধতায়। স্বদেশ, সমাজ, সমকাল এবং অস্তিত্বের হাহাকারকে উপজীব্য করে কবিতার যে শক্ত কুটির নির্মাণ করে চলেছেন, তা এক কথায় অনন্য। সেলিনা শেলীর কাব্যভাষা ও স্বর সমসাময়িক অন্য কবির চেয়ে আলাদা। সেই স্বর কখনো উচ্চকিত, কখনো নি¤œ। দেশ-সমাজ ও জাতির প্রয়োজনে কখনো কখনো কবিকে এরকম উচ্চ স্বরে কথা বলতে হয়। তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে, আছে যুগযন্ত্রণার অস্ফুট অনুভব। জীবনযাপনের নানা সংকট ও কোলাহলের ভেতর দিয়ে তাঁকে অতিক্রম করতে হয় কণ্টাকীর্ণ পথ। তিনি নিজে বলেন,
‘অনেক ক্লান্তির ভেতর জীবিকার জটিল জঙ্গমে আমি যখন হাঁপিয়ে উঠি, তখনো নিজেকে পুনঃনির্মাণ করতে চাই। আজকে সেলিনা শেলী হয়ে উঠতে বহু বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আমাকে। পরিবার-সমাজ এবং পুরুষতান্ত্রিক কবিমানসের ভেতর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার এই যুদ্ধ অনেক কঠিন। আমি কখনও দশের মধ্যে এক হতে চাইনি, এগারো হতে চেয়েছি। যা ভালো, অকপটে বলি, ভালো না হলে তাও বলি। আমাদের কবিরা নিজের প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে কিন্তু অপরের প্রশংসায় বড় কৃপণ। এই দীনতা কাউকে বড় করে না। সমস্যা যে, রক্তের মতো আমাদের বোধের তো উত্তরাধিকার ঘটে না। আমরা এই জাগতিক বিশ্বের এমন এক প্রাণি, যারা কেবল ইচ্ছা-পদ্ধতিতেই চলি। আর সেই ইচ্ছা-পদ্ধতিটি নারীর জন্যে আজও পুরোপুরি অর্গলমুক্ত নয়। আবার উল্টো করেও বলা যায়, সে চাইলেই পুরোপুরি অর্গলমুক্ত হতে পারে, তবে তার আগে আরও বহু জায়গা থেকে তাকে মুক্তি নিতে হবে। সেলিনা শেলী এইসব ঘেরাটোপের বাইরে নয়, ভেতরে।’
তবে এতো সংগ্রাম সংকটের পরও সেলিনা শেলীর কবিতানির্মাণ ‘সুন্দরের চমৎকার অনুশীলন’। ভাষা, ভাব, আঙ্গিক, কৌশল, প্রকরণ-সব দিক থেকে তিনি যতœবান। তিনি যেমন বাংলা কবিতার আবহমান ধারাকে আঁকড়ে রেখেছেন, তেমনি কবিতায় নিরীক্ষার কাজটা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন মোটা দাগে।
আর্তুর র্যাঁবো লিখেছেন, “কবি হবেন দ্রষ্টা, নিজেকে তিনি বানাবেন দ্রষ্টা। নিজেকে তিনি দ্রষ্টা বানাবেন সমস্ত ইন্দ্রিয়ের এক দীর্ঘ বিশাল আর সচেতন ভ্রষ্টতার ভিতর দিয়ে। সব রকমের প্রেম, কষ্ট এবং উন্মাদনার মধ্য দিয়ে। কবি নিজেকে খোঁজেন। নিজের ভিতরের সব বিষকে তিনি খরচ করে ফেলেন, রেখে দেন শুধু তাদের নির্যাস। অকথ্য অত্যাচার করেন নিজের উপর, যেখানে তাঁর সমস্ত বিশ্বাস প্রয়োজন, সমস্ত অমানুষিক ক্ষমতা, যেখানে তাঁকে হয়ে উঠতে হয় সমস্ত মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় রোগী, বিশাল অপরাধী এবং অভিশপ্ত এক জন। আর, বিশাল প-িত। কেননা, তিনি পৌঁছতে পারেন অজানায়।”
সেলিনা শেলীও তাঁর সমস্ত ক্ষমতা ও বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটান তাঁর কবিতায়। নিজেকে খোঁজেন কবিতায়। তাঁর কবিতা একরৈখিক নয়, ‘চিন্তানুচিন্তনে, বিষয়ে ও প্রকরণে’ বহুমুখী। প্রজ্ঞা, মেধা ও সৃজনশীলতা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন কাব্যভুবনে।
প্রবন্ধ ও কবিতা বিষয়ক গবেষণাতেও তিনি অসাধারণ। ইতোপূর্বে তাঁর গবেষণাধর্মী প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কবিতার ব্যঞ্জন ও ব্যঞ্জনা’ ব্যাপকভাবে পাঠক সমাদৃত হয়েছে। ‘সেদিন কী দিন ছিল এ দিন কী দিন’ ‘কতিপয় কবিতার কথা’ ও ‘কবে থেকে ট্রেনে ওঠে বাংলা কবিতা’য় শক্তিমান গদ্যশিল্পীর পাশাপাশি তার প্রজ্ঞা ও মননশীলতার পরিচয় পান পাঠক। কবিতায় সেলিনা শেলীর স্বর যেমন নিজস্ব, তেমনি গদ্যেও রয়েছে তাঁর নিজস্বতা।
এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : কাব্য: অন্ধকার হে অন্তর্গত, নিভে আসে সূর্য সকাল, চিতাচৈতন্যের গান, দ্বিধাসংহিতা, তাচ্ছিল্যকুসুম; ছোটগল্প: হনন; প্রবন্ধ/গদ্য: কতিপয় কবিতার কথা, সেদিন কী দিন ছিল এ দিন কী দিন, কবিতার ব্যঞ্জন ও ব্যঞ্জনা, কবে থেকে ট্রেনে ওঠে বাংলা কবিতা।
সেলিনা শেলী আশির দশকের গোড়া থেকেই সাহিত্য চর্চা করে চলেছেন। ছাত্র জীবনে নানা সাংগঠনিক তৎপরতা,অভিনয়, আবৃত্তি, বিতর্কসহ সকল সাংস্কৃতিক কাজ ও খেলাধুলায় তিনি অগ্রণী ছিলেন। বামধারার ছাত্র রাজনীতিতে নব্বইয়ের গণআন্দোলনে, চাকসু নির্বাচনে, এবং যুদ্ধঅপরাধীর বিচারের কার্যক্রমে তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের যুগ্ম সম্পাদক, কালচারাল স্কোয়াড চ. বি.এর যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। মৌলবাদী জামাতশিবিররের হাতে তিনবার বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার শিকার হন তিনি। ৯০ এর ২২ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের বর্বরতম হামলার পর রাজনীতিবিদ মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁকে তিনমাস ফ্রি চিকিৎসা দিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার এর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিরকুমারসভা এবং রাশান নাটক — বিপ্লবগাথায় অভিনয় করে সারাদেশে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন।
তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও মাস্টার্স করেছেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর মহিলা কলেজ এ উপাধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষে মুক্তচিন্তার লড়াইয়ে সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ভূমিকায় অত্যুজ্জ্বল তাঁর ছাত্রজীবন। আশির দশক থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কবিতা গল্প প্রবন্ধ মুক্তগদ্য লিখে চলেছেন। ইতোমধ্যে নানা সংগঠনের সম্মাননাও পেয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কবি সাংবাদিক শাহিদ আনোয়ারের স্ত্রী। সেলিনা শেলীর জন্ম: ১৭ জুলাই, ১৯৬৭, চট্টগ্রামে। পৈত্রিক বাস: বরুরা, কুমিল্লা।