ড. মাহবুবুল হক-এর জীবনপঞ্জি

শিক্ষাবিদ ড. মাহবুবুল হক জ্ঞান-সাধনায় আজন্ম নিমগ্ন একজন বহুমাত্রিক মানুষ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। শিল্প-সাহিত্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতি তথা বাঙালির সামগ্রিক যাত্রায় তিনি এক প্রাগ্রসর পথিক। ড. মাহবুবুল হক একাধারে অধ্যাপক, ভাষাবিদ, প্রাবন্ধিক, লোকগবেষক, সমালোচক, সুবক্তা ও সংগঠক। পাশাপাশি প্রগতিশীল সংস্কৃতি ও রাজনীতি চর্চায় দেশের একজন সংগ্রামী মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন। মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী দেশের প্রতিটি ক্রান্তিকালে অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে সদা জাগ্রত ও অবিচল থেকেছেন। প্রগতিশীল শিক্ষা-সমাজ-সভ্যতা তথা মানব মুক্তি ও মানব বিকাশে এখনও তিনি সতত সক্রিয়। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও অপরিসীম ধৈর্য ও মনোবলের সাথে তিনি নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কাজে যথাসাধ্য বিচরণশীল।

জন্ম ও বসবাস
মাহবুবুল হকের জন্ম ১৯৪৮ সালের ৩রা নভেম্বর, ফরিদপুরের মধুখালিতে। বাবার চাকরিসূত্রে চট্টগ্রামে আসা এবং স্থায়ীভাবে বসবাস। বাবা মরহুম আবদুল মালেক ও সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি ট্রেড ইউনিয়ন এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মা মোছাম্মৎ হাজেরা খাতুন রতœগর্ভা জননী।

শিক্ষা জীবন
মাহবুবুল হক প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করেন বাগমণিরাম বালক বিদ্যায়লয় থেকে। তিনি তৎকালীন চট্টগ্রাম পৌরসভার ৪৬টি স্কুলের মধ্যে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৬৪ সালে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে এসএসসি ও ১৯৬৬ সালে পাস বিভাগে এইচএসসি এবং একই কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে বাংলায় স্নাতক সম্মান ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ. তে প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় হন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৫ সালে এমফিল কোর্স ওয়ার্কে প্রথম শ্রেণি অর্জন করেন। এখান থেকেই ড. মনিরুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে পিএইচ.ডি. উপাধি লাভ করেন ১৯৯৭ সালে। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘তিনজন আধুনিক কবি : সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সুকান্ত ভট্টাচার্য।’

লেখালেখি ও সম্পাদনা
স্কুল জীবন থেকেই লেখালেখি শুরু। অষ্টম শ্রেণিতে ‘নবদিগন্ত’, নবম ও দশম শ্রেণিতে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল বার্ষিক সম্পাদনের মাধ্যমে সম্পাদনার হাতেখড়ি। ১৯৬৪-তে দ্বিমাসিক সাহিত্যপত্র ‘কলরোল’ সম্পাদনা করেন। এই পত্রিকাতেই একুশের প্রথম আলেখ্য উপন্যাসিকা তা-সেন রচিত ‘লাল রঙ পলাশ’ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৭ তে ‘মিছিল’, ‘অন্বেষা’, ‘পদাতিক’, ‘রবিকরে কবিকণ্ঠে’; ১৯৭৯ তে ‘সাহসী’ ‘ঠিকানা’; ১৯৮১-তে চিটাগাং গাইড; ১৯৯৫-এ ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’; ১৯৯৭ ও ২০০১-এ ‘আজকে আকাশ তলে’ সম্পাদনা করেন। আবুল ফজল, আবদুল হক চৌধুরী, ওহীদুল আলম প্রমুখের প্রয়াণ স্মরণিকা ও সংকলন সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর আরও একটি উল্লেখযোগ্য সম্পাদনার মধ্যে আছেন নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের সংবর্ধনা স্মারক (২০০৭)।
বাংলা ভাষা ও বানান বিষয়ক গ্রন্থ লিখে মাহবুবুল হক দেশে-বিদেশে গুণীজনের প্রশংসা অর্জন করেছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বেশ কয়েকটি আবশ্যিক ও সহপাঠ বাংলা পাঠ্য বইয়েরও রচয়িতা তিনি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বাংলা পাঠ্যবই প্রণয়নে গুণগত পরিবর্তন আনার কৃতিত্ব তাঁর। শিশু-কিশোরদের উপযোগী বই লেখার তাগিদও ছিল তাঁর। প্রায়োগিক বাংলা ও ফোকলোর চর্চা, অনুবাদ ও গবেষণা এবং সংকলন ও সম্পাদনার মাধ্যমে তিনি পরিচিতি লাভ করেছেন দেশে ও দেশের বাইরে। বাংলাদেশ, ভারত ও পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত হয়েছে ৪০টিরও বেশি বই। প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে দেশ-বিদেশের বহু সাময়িক পত্র ও সংকলনে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সৃজনশীল বিচিত্র শাখা-প্রশাখায় বিচরণ না করলেও মাতৃভাষার প্রতি প্রগাঢ় ও মমত্ববোধ থেকে এ জাতীয় রচনা অনুষঙ্গ হয়েছে শেকড়সন্ধানী ও সমাজ সচেতন এ লেখকের।
মাহবুবুল হকের প্রবন্ধ ও গবেষণা গ্রন্থ সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ‘ম্যাক্সিম গোর্কির মা’ (১৯৭৯); ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ পরিচিতি’ (১৯৮১); আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (১৯৮২); ‘বাংলা বানানের নিয়ম’ (১৯৯১); ‘আশুতোষ চৌধুরী’ (১৯৯৪); ‘পাঠ্য বইয়ে বাংলা বানানের নিয়ম’ (১৯৮২); ‘বিশ্ব তারিখ অভিধান; (২০০০), ‘বাংলা ভাষা : কয়েকটি প্রসঙ্গ’ (২০০৪); ‘তিনজন আধুনিক কবি : সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সুকান্ত ভট্টাচার্য’ (২০০৫); সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি (২০০৮), ‘বাংলা সাহিত্য : কয়েকটি প্রসঙ্গ’ (২০০৯); ‘বাংলা সাহিত্য : নানা নিবন্ধ’ (২০০৯), ‘বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ : নানা নিবন্ধ’ (২০১০), ‘নজরুল তারিখ অভিধান’ (২০১০। এই গবেষণার জন্য নজরুল বিশ^বিদ্যালয়ের নজরুল পদকে ভূষিত); ‘বাংলার লোকসাহিত্য : সমাজ ও সংস্কৃতি’ (২০১০। এই গবেষণার জন্য মধুসূদন পদকে ভূষিত); ‘বাংলা সাহিত্যের দিক-বিদিক’ (২০১১), ‘রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ’ (২০১১) ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’ (২০১২); ‘অন্বেষার আলোয় চট্টগ্রাম’ (২০১২), ‘রবীন্দ্রসাহিত্য রবীন্দ্রভাবনা’ (২০১৪); ‘বাংলা কবিতা : রঙে ও রেখায়’ (২০১৫); ‘বইয়ের জগৎ : দৃষ্টিপাত ও আলোকপাত’ (২০১৬), ‘মুক্তিযুদ্ধ ফোকলোর ও অন্যান্য (২০১৫); ‘ লোকসংস্কৃতি ও লোকসাহিত্য’ (২০১৬), ‘খটকা বানান অভিধান’ (২০১৭)।
তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ সমূহের মধ্যে রয়েছে : নির্বাচিত প্রবন্ধ : আবুল ফজল (২০০২); শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত (২০০৪); সমকালের কবিয়াল (শিশির দত্ত সহযোগে ২০০৭); সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পদাতিক’ (২০০৮), চাটগাঁ ভাষার রূপ পরিচয় ( যৌথ, ২০১২)। এছাড়াও তিনি ‘অক্টোবর বিপ্লবের বিজয়গাথা (১৯৮২); মৌমাছি ও মানুষ (মস্কো, ১৯৮৮); টাইম মেশিন (১৯৮৯) অনুবাদ করেছেন। তিনি কয়েকটি শিশুকিশোর গ্রন্থ লিখেছেন। সেগুলো হলো : ‘গল্পে গল্পে ভাষা আন্দোলন’ (২০১৮), ‘মরণজয়ী অভিযানের কাহিনি’ (২০১৭), ‘ভাষার লড়াই থেকে মুক্তিযুদ্ধ’ (২০১৬), ‘গল্পে গল্পে নজরুল’ (২০০৯), ‘বীরশ্রেষ্ঠদের কথা’ (২০০২); ‘ছড়ায় ছড়ায় বাংলা বানান (২০০১); ‘কুৃমির, বিড়াল ও খরগোশের গপপো’ (২০০১); ‘বাতাসের কথা’ (২০০১); সবই হলো কিসমত (২০০১); ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ (সম্পাদিত রবীন্দ্র কিশোর রচনা সংকলন ২০০১);

সাংস্কৃতিক যাপন
চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে অধ্যয়নকালে আবৃত্তি, বিতর্ক, অভিনয়, চিত্রাঙ্কন চর্চায় সক্রিয় হন। চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নকালে সৃজনশীল সাংস্কৃতিক নানা কর্মতৎপরতার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সাড়া জাগান। তাঁর পরিচালনায় ১৯৬৬ সালে বাংলা একাডেমীর বটমূলে ‘লাল রং পলাশ’ নামের ছায়ানাট্যের মঞ্চায়ন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে চমক সৃষ্টি করে। ১৯৬৭ সালের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্মিত বিশাল মিলনায়তনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘লাল রং পলাশ’-এর মঞ্চায়ন সে সময় ঐ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সাড়া জাগানো ঘটনা। এছাড়া ১৯৬০-এর দশক থেকে অধ্যাবধি তিনি চট্টগ্রামের নানা সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সাথে নানাভাবে যুক্ত আছেন।

কর্মজীবন
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাহবুবুল হক দেশ গড়ার গঠনমূলক কাজে সংগঠক হিসেবে কাজ করায় ব্রতী হন। সে সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যোগদানের আমন্ত্রণ পেলেও তিনি তাতে সাড়া দেননি। বাংলা একাডেমির গবেষক হিসেবে মনোনয়ন পেলেও তিনি তাতে যোগ দেননি। ১৯৭২ সালে দেশের সমাজতান্ত্রিক অভিযাত্রার কথা সামনে রেখে তিনি সমাজতান্ত্রিক দেশ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য প্রায় এক বছরের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নে অবস্থান করেন।
১৯৭৬ সালে তাঁর পিতার আকস্মিক মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের হাল ধরতে তিনি চাকরি নিতে বাধ্য হন এবং পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকেই বেছে নেন। কর্মজীবনের শুরু ১৯৭৮ সালে, রাঙ্গুনিয়া কলেজে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে। ১৯৮১ সালে যোগদান করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলা বিভাগে। ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেন এবং ২০১৬ সালের জুনে অবসর গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়-এর উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন (২৪ আগস্ট ২০১৬ থেকে ৮ জুলাই ২০১৭)। বর্তমানে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে আছেন।

রাজনৈতিক জীবন
চট্টগ্রাম কলেজে সাংস্কৃতিক কর্মতৎপরতার পাশাপাশি মাহবুবুল হক ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন। তিনি বামপন্থি ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সংযুক্ত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি ও ১৯৭০ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে উনসত্তরের গণ-অভ্যূত্থ্যান সংগঠিত করায় ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে চট্টগ্রামে অসহযোগ আন্দোলন সফল করা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন, অস্ত্র সংগ্রহ ও ট্রেনিং প্রদান, সাংস্কৃতিক স্কোয়াড গঠন করে সর্বত্র জনগণকে উদ্বুদ্ধ করায় তিনি ছাথ্র সমাজকে নের্তত্ব দেন। ২৬ শে মার্চের পর বিদ্রোহী বাঙালি সেনাদের খাদ্য সরবরাহসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করেন। ১৯৭১ সালের জুনে আগরতলায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, আগরতলায় কর্তাবাড়ি রিক্রুটিং ক্যাম্পের পরিচালক এবং বরদুয়ালির বেজ ক্যাম্পের সহযোগী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে ‘এসো এবার দেশ গড়ি’ আন্দোলন গড়ে তোলেন। এম. এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেয়েও চাকরিতে যোগদান না করে বঙ্গবন্ধুর দেশ পুনর্গঠন কার্যক্রমে ছাত্র সমাজকে যুক্ত করার লক্ষ্যে সার্বক্ষণিক কর্মী ও সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ে দুস্থ মানুষের জন্য চট্টগ্রামে ত্রাণ কার্যক্রম চালু করেন। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন পর্বে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক মাহবুবুল হক চট্টগ্রাম জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মনোনীত হলে চট্টগ্রামের দেওয়ান হাট মোড়ে চট্টগ্রামের যুব সমাজের পক্ষথেকে বঙ্গবন্ধুকে বিশাল সংবর্ধনা প্রদান করেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে নিহত হবার পর ত্রাসের রাজত্বের মধ্যে জাতির পিতার ভাবমূর্তি পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্যপদ গ্রহণ ও শহিদমিনারের সামনে আলোচনা সভায় প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

সাংগঠনিক চর্চা
তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংগঠনের গুরুত্ব পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন এবং করে আসছেন। জীবন সদস্য পদ প্রদান করে বহু প্রতিষ্ঠান তাঁকে সম্মানিত করেছেন। তিনি দীর্ঘকাল (১৯৭৮-২০১৭) বাংলা একাডেমির জীবন সদস্য ছিলেন। বর্তমানে একাডেমির ফেলো। তাঁর সাংগঠনিক ভূমিকার মতাঁর সাংগঠনিক ভূমিকার মধ্যে রয়েছে : জীবন সদস্য, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি (২০০৩ থেকে বর্তমান); অন্যতম উদ্যোক্তা বিজয় মেলা পরিষদ, চট্টগ্রাম (১৯৮৯-১৯৮০); সদস্য, বাংলাদেশ সাহিত্য সমিতি, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় (২০০৮-২০১৫); সঞ্চালক, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যাল ডিবেটিং সোসাইটি (১৯৯৯-২০১৭। এসময় তিনি চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যাল ডিবেটিং সোসাইটিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্ত করেন।) আহ্বায়ক কমিটির সদস্য, চিটাগিাং সেন্টার ফর এডভান্স স্টাডিজ (২০১৪-বর্তমান পর্যন্ত); পরিচালনা পরিষদ সদস্য, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, চট্টগ্রাম (২০০৭ থেকে বর্তমান পর্যন্ত); জীবন সদস্য, চাটগাঁ ভাষা পরিষদ (২০০৬) এবং সহ-সভাপতি (২০১৫ থেকে বর্তমান পর্যন্ত); সদস্য, পরিচালনা পরিষদ, শিল্পকলা একাডেমি, চট্টগ্রাম (?); সদস্য, পরিচালনা পরিষদ, মুসলিম ইনস্টিটিউট (২০১৮ থেকে বর্তমান পর্যন্ত); সভাপতি ফোকলোর উৎসব ও পুরাতনী মেলা, চট্টগ্রাম (২০০৬ থেকে বর্তমান পর্যন্ত); সদস্য, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, চট্টগ্রাম; সাধারণ সম্পাদক, নজরুল পরিষদ চট্টগ্রাম (১৯৯৩-১৯৯৪); কার্যকরী সদস্য, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী ( ১৯৮০ ও ৯০-এর দশক), সভাপতি লোক সাংস্কৃতিক একাডেমি (২০১৮)।

কৃতিত্ব ও অবদান
বিশেষজ্ঞ হিসেবে বাংলা একাডেমী, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি), শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটসহ নানা বিদ্বৎ প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় দায়িত্ব পালন করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, যাদবপুর, বিশ^ভারতী ও কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেন্ট পলস কলেজ, বেথুন কলেজ ও তমলুক কলেজ, পাঞ্জাবের পাতিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং আগরতলায় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সম্মেলন ও সেমিনারে অংশ নিয়েছেন। গবেষণা-প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন বাংলা ভাষা-সাহিত্য ইতিহাস ও ফোকলোর বিষয়ে। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত প্রথম সার্ক উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেছেন ২০০৭ সালে।
উল্লেখ্য, মাহবুবুল হক বাংলাদেশে বাংলা বানানের সমতা বিধান ও প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম প্রণয়নের কাজে বিশেষজ্ঞ তথা অন্যতম পুরোধা হিসেবে অবদান রেখেছেন। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি অনুসারে প্রাথমিক, নি¤œ-মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বাংলা বিষয়ের শিক্ষা কার্যক্রম প্রণয়নে ও পাঠ্যপুস্তক রচনায় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন শাখায়, বিশেষ করে আধুনিক বাংলা কবিতার প্রগতিশীল সমাজচেতনামূলক ধারার স্বরূপ নিরূপণে এবং নজরুলের প্রামাণ্য জীবনপঞ্জি রচনায় ড. মাহবুবুল হক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বাংলা ভাষা গবেষণায় তিনি নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। সংস্কৃতের প্রভাবমুক্ত ও বাংলা ভাষার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নির্দেশক প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ রচনায় বাংলা একাডেমির উদ্যোগ বাস্তবায়নে তিনি যুগপৎ কোর কমিটির আহ্বায়ক, লেখক ও সম্পাদক হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন।

পুরস্কার ও সম্মাননা
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা ও প্রবন্ধ রচনায় সামগ্রিক অবদানের জন্য ড. মাহবুবুল হক বহু সম্মান ও পুরস্কার লাভ করেছেন। উল্লেখযোগ্য হলো : একুশে পদক (২০১৯) বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৭), চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন সাহিত্য পুরস্কার (২০১৭), নজরুল বিশ^বিদ্যালয় সম্মাননা (২০১৬), ড. রশিদ আল ফারুকী পদক (২০১৬), কবি মধুসূদন পদক (২০১১); আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়র সম্মাননা (২০১১); চট্টগ্রাম একাডেমি পুরস্কার (২০০৮); মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা সম্মাননা (১৯৯৩), ফিলিপস পুরস্কার (১০৬৭) ইত্যাদি

পারিবারিক জীবন
তিন ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে ড. মাহবুবুল হক সবার বড়। ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয় জন ক্যাপ্টেন অব: আশরাফুল ইসলাম সামরিক বাহিনী থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত আছেন। তৃতীয় ভাই আমিনুল ইসলাম ফরিদপুরের পৈতৃক নিবাসে বসতি নিয়েছেন। প্রথম বোন হাসিনা বেগম গৃহিনী। দ্বিতীয় বোন রাজিয়া বেগম বাংলাদেশ রেলওয়ের চট্টগ্রাম কার্যালয় থেকে অবসরপ্রাপ্ত। তৃতীয় বোন সালেহা বেগম অ্যালেন আবুধাবীতে প্রবাসী। তিনি একসময় প্রাথমিক শাখায় সেরা স্কুল শিক্ষক মনোনীত হয়েছিলেন। চতুর্থ বোন ফিরোজা বেগম যুগ্ম সচিব ও পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের প্রধান। পঞ্চম বোন মাহফুজা আক্তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। ষষ্ঠ বোন মাসহুদা ইয়াসমিন সম্পাদনা, সাংবাদিকতা ও লেখালেখির সাথে যুক্ত।
স্ত্রী ছালেহা বেগম ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের প্রাক্তন সিনিয়র শিক্ষক। কন্যা উপমা মাহবুব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে পাশ করে বর্তমানে ব্র্যাক-এর গ্লোব্যাল অ্যাডভোকেসি বিভাগের ব্যবস্থাপক। তিনি লেখালেখি অঙ্গনে সক্রিয়। জামাতা তাহমিদ অমিত যমুনা টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার। নাতনি প্রমিতি লেখা কিন্ডার গার্টেনের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির অপেক্ষায়। পুত্র উপল মাহবুব বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে থাককালে বৃত্তি নিয়ে আমেরিকার মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ ডি করেছেন। বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ায় কর্মরত। বিদেশি ভাষা, সংগীত ও কারুশিল্পের অঙ্গনে তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ। পপুলার মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন প্রভাষক পুত্রবধূ ডা. তাসনুভা চৌধুরী বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা।

মানবতাবাদী মাহবুবুল হক একজন কর্মবীর মানুষ। তাঁর সামগ্রিক কর্মপ্রয়াস বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আকাশে চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। আত্মপ্রত্যয়ী প্রাণবান পুরুষ হিসেবে সময়ের প্রবল প্রচারকামী সমাজের বিপরীতে তিনি বরাবরই নীরব সাধক। এছাড়াও এদেশের শোষিত বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে পুরো জীবন ব্যায় করেছেন যা উত্তরপ্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। বয়সে প্রবীণ হলেও চিন্তা ও কর্মে এখনও তিনি তারুণ্যের অভিযাত্রিক।

Show sidebar

No products were found matching your selection.