সাখাওয়াত হোসেন মজনু : পরিশ্রমী প্রাবন্ধিক ও নিষ্ঠাবান গবেষক
সাখাওয়াত হোসেন মজনু। দেশের বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক হিসেবে যেমন পরিচিত, তেমনি নিষ্ঠাবান গবেষক হিসেবেও সমাদৃত। আজাদীর কারণে কলামিস্ট হিসেবেও তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে দেশে ও দেশের বাইরে। জন্ম : ২০ এপ্রিল ১৯৫৭, চট্টগ্রামে। পিতা : বেলায়েত হোসেন, মাতা : হোসনে আরা বেগম। বাংলা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নিয়েছেন এম এ ডিগ্রি।
পূর্বপুরুষ সমরকন্দ থেকে ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দে এই উপমহাদেশে আসেন মোগল স¤্রাট জহিরুদ্দিন মো. বাবর এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে। ইসলাম প্রচার এবং আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ ছিলেন বলে স¤্রাট তাঁকে প্রশাসনের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে ইসলাম প্রচারের জন্য স্বাধীন ভাবে কাজ করার সুযোগ প্রদান করেন। স্বপ্নে নির্দেশিত হয়ে তাঁরা কেউ দিল্লিতে থেকে যান। আবার কয়েকজন গৌড়, ত্রিপুরা হয়ে কুমিল্লার কয়েকটি স্থানে ইসলাম প্রচারের জন্য বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন স্থানে স্থায়ী আবাস গড়েন। পরবর্তী সময় এই বংশের কয়েকজন প্রায় দু’শ বছর পূর্বে এই শহর চট্টগ্রামে স্থায়ী হন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক দেশবাংলার একজন কিশোর কর্মী হিসেবে ছোট ছোট সংবাদ লিখতে লিখতে সাখাওয়াত হোসেন মজনুর লেখার হাতে খড়ি। তারপর গণকন্ঠ এবং শিক্ষকতার মাধ্যমে ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে থেকে এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান এর তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম অঞ্চলের তৃণমূলে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু। তবে তিনি তাঁর ক্ষেত্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে শহর চট্টগ্রামকে বেছে নিয়েছেন। গবেষণার ফল হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে,
নির্যাতন’ ৭১, রণাঙ্গনে সূর্যসৈনিক, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহর চট্টগ্রামের বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্র, মধ্যম নাথপাড়া ও আবদুর পাড়া বধ্যভূমি, মুক্তিযুদ্ধে আমার কৈশোর।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকাকালীন ৫৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ নামে ১০ পর্বের একটি ডুকুমেন্টারি ফ্লিম করেছিলেন। সেখানে সাখাওয়াত হোসেন মজনুর প্রথম ৪টি গ্রন্থের তথ্য উপাত্ত স্থান পেয়েছিলো। ফলে মেয়র সামরিক শাসকদের রোষানলে পড়ে মামলার মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং তাঁকে চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে স্থাপিত সামরিক দপ্তরে অনেক জেরার মুখে পড়তে হয়েছিলো।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামী ও শহীদ সৈয়দ নিছার আলী তিতুমীর এর জীবনতথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ব্রিটিশ রাজ নিযুক্ত প্রকাশিত তিতুমীর এর জীবন কাহিনীর বিপরীতে সাখাওয়াত হোসেন মজনু ও তাঁর স্ত্রী তিতুমীর এর জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার হায়দারপুর গমন করেন। এই মহান বীর কেমন করে ইংরেজ শাসক এবং নীল ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনী তৈরি করেছিলেন, কেমন করে নারকেল বেড়িয়ায় বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে ৬ দিন ইংরেজ সৈন্যদের প্রতিরোধ করেছিলেন সে তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছিলেন হায়দারপুর, চাঁনপুর, টাকি, পুরি, গোবরডাঙ্গাসহ এলাকার তৃণমূলে ঘুরে এখনো প্রকৃত তথ্য উদঘাটন করার চেষ্টা করছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় শহর চট্টগ্রামের তৃণমূলের অবস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় কেন্দ্র, গৌরবদীপ্ত অপারেশন, বধ্যভূমি, নির্যাতন কেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সহায়ক শক্তি মা-বোনদের গৌরবগাথা, ঘাতক বাহিনীর সহযোগী ও পাকিস্তান বাহিনীর দোসরদের তৃণমূলের তথ্য সংগ্রহের ২য় পর্বের কাজ শেষ করেছেন। অর্থ এবং সময়ের সমন্বয় ঘটলে প্রায় ১০০০ (এক হাজার) পৃষ্ঠার গ্রন্থটি ২টি খন্ডে প্রকাশের ইচ্ছা রয়েছে সাখাওয়াত হোসেন মজনুর। মুক্তিযুদ্ধের বিশাল ক্যানভাস এই শহর চট্টগ্রাম। নতুন নতুন ক্ষেত্র সম্বন্ধে নিয়মিত তথ্য আসছেই।
এশিয়াটিক সোসাইটি অভ বাংলাদেশ-এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ এর সম্পাদনায় প্রকাশিত Encyclopedia of Bangladesh War of Liberation গ্রন্থের ১০ পর্বের মধ্যে এই লেখকের শহর চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা পর্বের অনেকগুলো গবেষণা কর্মস্থান পেয়েছে।
দৈনিক আজাদী সাবেক সম্পাদক প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ এবং বর্তমান সম্পাদক এম.এ মালেক এর পৃষ্ঠপোষকতায় সাখাওয়াত হোসেন মজনু ১৯৯০ থেকে দৈনিক আজাদীতে সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি কলামটি লিখছেন।
সাখাওয়াত হোসেন মজনুর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মোট ২৩টি। তবে মুক্তিযুদ্ধের ও জীবনী গ্রন্থগুলো সমাজে চেতনার কথায় সমৃদ্ধ। গ্রন্থগুলো প্রতিটি পরতে পরতে ছোঁয়া সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর স্ত্রী শিক্ষাবিদ, কবি, ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক মর্জিনা আখতার এর পরশে। অনুপ্রেরণা মূলত ওখানেই।
স্বীকৃতি বা পুরষ্কার হচ্ছেন পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী বন্ধুরা। তবে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের স্বীকৃতি ও সম্মাননা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখক বয়সে কিশোর এস এস সি পরীক্ষার্থী। তবে ছাত্রলীগের আগ্রাবাদ অঞ্চলের কর্মী ছিলেন। সে বয়সে অর্থাৎ ১ মার্চ থেকে অসংখ্য মানুষের সাথে মিছিল, মিটিং এবং প্রতিরোধে কিশোরের মতোই কাজ করেছেন। বাদামতলী মোড়ে অস্ত্র বোঝাই জাহাজ সোয়াত প্রতিরোধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পুরো পরিবার আত্মগোপনে চলে যান। তবে মে মাস থেকে ফিরে এসে রাজপথের বন্ধুদের সন্ধান মেলে। যোগাযোগ স্থাপিত হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা তোহা গাজী, বীর মুক্তিযোদ্ধা রইসুল হক বাহার, বীর মুক্তিযোদ্ধা গরীব উল্লাহ, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ শফি মুন্সী এবং আরো ক’জনের সাথে। তবে ডা. মাহফুজ, তোহা গাজী, রইসুল হক বাহার লেখককে কাজে লাগান গোপনে প্রচারপত্র বিলি, ছোট অস্ত্র, এক্সক্লুসিভ ও তথ্য আদান প্রদানে। এক্ষেত্রে উত্তর নালাপাড়ার দেওয়ান শামসুন নাহার মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠানো অস্ত্র, গোলাবারুদ, তথ্য সংরক্ষণ করেন সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনায়। লেখক ছিলেন এই কাজগুলোর সহযোগী।