বিশ্বজিৎ চৌধুরী : চৈতন্য টান টান করা রচনায় যিনি সঞ্চার করেন উজ্জীবনী শক্তি

বিশ্বজিৎ চৌধুরী একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, কলামলেখক, নাট্যকার, সমালোচক ও কিশোর সাহিত্যিক। যখন যেটা লিখেছেন এবং লিখছেন, সেটা অনন্য ও অসাধারণ হয়ে পাঠকের কাছে ধরা দেয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সৃষ্টি করেছেন নতুন ধারা।
জীবনের অন্য সব ক্ষেত্রের মতো সাহিত্যও যে অপরিহার্য বিষয়, যেটা আমরা বুঝতে পারি, বিশ্বজিৎ চৌধুরীর মতো লেখকদের সপ্রাণ উপস্থিতিতে। তাঁর সমগ্র সাহিত্য মানব জীবনেরই প্রতিচ্ছবি এবং মানুষের উজ্জীবনী শক্তি। পাঠকের সুপ্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তোলার কষ্টার্জিত শ্রমলব্ধ প্রয়াস লক্ষ্যণীয়। তাঁর প্রতিটি রচনা যেমন গভীর ও অতলস্পর্শী, তেমনি ব্যাপক। তাতে আছে বিষয় ও ভাষার কারুকাজ, আছে অভিনব বর্ণনা, আছে ঔদার্য ও বিস্ময়।
এ পর্যন্ত অনেকগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। তন্মধ্যে রয়েছে : কাব্যগ্রন্থ : ১.তোমার প্রাণের জল, শ্যাওলা শরীরে ২.ও বন্যাপ্রবণ ৩.মাঠের ওপারে যাবে, লীলা? ৪.নির্বাচিত কবিতা; গল্পগ্রন্থ ১.বিবাহবার্ষিকী ও অন্যান্য গল্প, ২.সম্ভ্রমহানির আগে ও পরে ৩. স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রেমের গল্প ৪. দুধারি তলোয়ার ৫.সেরা দশ গল্প ৬.নির্বাচিত গল্প ; উপন্যাস : ১.তুমি কি ভালোবেসেছিলে? ২.একটি নিঃসঙ্গ তালগাছ ৩.নার্গিস ৪.বাসন্তী, তোমার পুরুষ কোথায় ৫.হে চন্দনা পাখি ৬.দূর-সম্পর্ক ৭.ফুটো; কিশোর গল্পগ্রন্থ : ১.লিন্ডা জনসনের রাজহাঁস ২.পাখির জন্য খোলা আকাশ ৩.ভূতের সঙ্গে পরির বিয়ে ৪.কিশোর গল্প, প্রবন্ধ/নিবন্ধ : ১.মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ ও অন্যান্য ২.সমকালীন চট্টগ্রামের চালচিত্র ৩.শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, গবেষণা: ১.কবি আহসান হাবীব : পরিণতির পরম্পরা।
সাহিত্যের নানা শাখায় স্বতঃস্ফূর্ত ও সক্রিয় হলেও কথাসাহিত্যই তাঁর প্রধান চর্চিত মাধ্যম। এ অঙ্গনে তাঁর কাজ ব্যাপক ও উল্লেখযোগ্য। জীবন ও ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস রচনা করে তিনি সমকালের অন্যতম মেধাবী কথাসাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন, দিয়েছেন তাঁর শক্তির পরিচয়।
হাসান আজিজুল হক এক লেখায় বলেছেন, ‘ইতিহাস আর উপন্যাস এক জিনিস নয়। এই দুয়ের মাঝে এক রসায়ন থাকতে হবে। একটা কেমিস্ট্রি থাকতে হবে। এই সংমিশ্রণকে আলাদা আলাদা করা যাবে না। এই রসায়নকর্মটা যে করতে পারে না, তার লেখক হওয়া চলে না। যে বাস্তবকে অবাস্তবের সাথে মেলাতে পারে না, সে বাস্তবের পেছনে পরাবাস্তব দেখতে পায় না। বাস্তবের পেছনে, গভীরে আরো কত বাস্তব আছে এটা যে দেখতে পায় না, সে বাস্তববাদী লেখক নয়। তার মানে কি এই যে, বাস্তববাদী লেখক হলে আমরা সবাই প্রতিদিন যা দেখছি তা-ই লিখব? তা লিখলেই হয়। কিন্তু তাতে কি ঔপন্যাসিক হওয়া যায়? সবাই ঔপন্যাসিক হয় না কেন? এজন্য যে, সবাই জীবনের গভীরে বাস্তবতা-অবাস্তবতার সংমিশ্রণ দেখতে পায় না। চোখের আকৃতি ছোট-বড় দিয়ে সুন্দর বিবেচনা হতে পারে। কিন্তু সাহিত্য বিবেচনা হয় না।’
বিশ্বজিৎ চৌধুরীর উপন্যাসে ইতিহাস আর কল্পনার সমন্বয় ঘটেছে চমৎকারভাবে। নার্গিসকে নজরুলের জীবনীর প্রচলিত আঙ্গিকে দেখবার যে ঐতিহ্য, তাকে ভেঙে দিয়ে তিনি নতুন একটি পথ রচনা করেছেন।
গল্প বলি, উপন্যাস বলি,সবক্ষেত্রে বিশ্বজিৎ চৌধুরী দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ফেরদৌস আরা আলীমের ভাষায়, গল্পকার বিশ্বজিৎ চৌধুরী জানেন গল্পের হাতটা কী ভাবে ধরত হয়, কখন কী ভাবে গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিতে হয়, পাঠককে কোন ভাবের ঘোরে ফেলে গল্পের কোন চরিত্রকে কোন কাজটা কখন করিয়ে নিতে হয়। গল্প যে শুধু ঘটনার নয়, চরিত্রের ভাব-ভঙ্গি, ভাষা-ভঙ্গি, চালচলনÑ সবকিছুতে গল্প চারিয়ে দেবার যে কৌশলটা চাই সেটি তাঁর করায়ত্ত। সংলাপে-সংলাপে গল্প গড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। তাঁর চরিত্রদের যাপিত জীবনের কোষে কোষে গল্প থাকে। সত্যিকারের সাপ হয়ে ছোবল দিতে সক্ষম তাঁর গল্প। আবার সর্পভ্রমে রজ্জুতে প্রাণসংশয়ের মতো ঘটনাও ঘটাতে পারে বিশ্বজিতের গল্প। চৈতন্য টান টান করা গল্পগুলো আমাদের সাহিত্যের বড় সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে।
বিশ্বজিৎ চৌধুরীর জন্ম ১৯৬০ সালে চট্টগ্রামে। শিক্ষা: বাংলা সাহিত্যে ¯স্নাতকোত্তর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা: সাংবাদিকতা। শিশুসাহিত্য দিয়েই লেখালেখির সূচনা।

Showing all 6 results

Show sidebar