রহীম শাহ : ধ্বনিময় কল্লোলের অভিসারী
রাশেদ রউফ

রহীম শাহ, শামসুর রাহমান যাঁকে অভিহিত করেছিলেন ‘নিষ্ঠাবান ছড়াকার’ হিসেবে। ছড়া রচনায় তাঁর বিশেষ খ্যাতি থাকলেও সাহিত্যের অপরাপর শাখাতেও তিনি সক্রিয়। শুধু সক্রিয় নন, চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিরবচ্ছিন্ন লেখালেখির মাধ্যমে তিনি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন বহুমাত্রিক সৃজনকুশলতা। ছড়ার পাশাপাশি কিশোরকবিতা যেমন নির্মাণ করেছেন, তেমনি লিখেছেন এবং লিখে চলেছেন গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, জীবনী, নাটক, ভ্রমণকাহিনী, সায়েন্স ফিকশন, বিজ্ঞান বিষয়ক নির্বাচিত লেখা, অনুবাদ প্রভৃতি। প্রতিটি শাখাতেই আছে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার ছাপ। আছে প্রতিভার দীপ্ত স্বাক্ষর।
রহীম শাহ’কে বলা যেতে পারে বহুপ্রজ লেখক। তাঁর লেখার বিশাল ভা-ার দেখে আমি যেমন আনন্দিত ও আপ্লুত হই, তেমনি অবাক হই! প্রচুর লিখেও তাঁর কোনো ক্লান্তি নেই, উৎসাহে পড়েনি ভাটা। বরং দ্বিগুণ-ত্রিগুণ উৎসাহে তিনি চাষ দিয়ে যাচ্ছেন তাঁর ফসলী জমিতে। তিনি বলেন, ‘ছোটদের জন্য যা প্রয়োজন, তা-ই লিখছি। কখনও নিজের তাগিদে, কখনও প্রকাশকের তাগিদে, কখনও পত্র-পত্রিকার সম্পাদকের তাগিদে। লেখার ধরন পাল্টেছে, বিষয়বস্তু পাল্টেছে। তাতে কিছু যায় আসে না, ছোটদের জন্য কিছু তো লেখা হচ্ছে। এ কারণে আমি আনন্দিত।’
আনন্দিত হলেও তাঁর শিল্পী-মন তুষ্ট নয়। আরও ভালো লেখা লিখবার অবিরাম প্রয়াস তাঁর মধ্যে আছে। এ তৃষ্ণা শেষ হবার নয়, যেহেতু তিনি শিল্পী। তিনি বলেন, ‘চেষ্টা করে যাচ্ছি অনবরত। যদি একটি ভালো লেখা আমার হাত দিয়ে আসে, সে অপেক্ষায় আছি। একটি ভালো লেখার জন্য চেষ্টা করতে করতে অনেকগুলো বই হয়ে গেল।’
তাঁর নিজের ভেতরে কতখানি চেষ্টা, তিনি কতটা নিবেদিত ও সাধনায় মগ্ন; তা অনুভব করা যায় তাঁর সৃষ্টিসম্ভার দেখে। তাঁর বিশাল লেখালেখির মধ্যে কিশোর কবিতাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে চাই। তাঁর কবিতায় স্বদেশবোধের চেতনা আছে, নিসর্গের চিত্রায়ন আছে, স্বপ্ন আছে, দুঃখ আর কষ্ট আছে, আছে স্বপ্নভঙ্গের কথকতা। কবিতায় কবি কখনও নরম-নীরব, কখনও বেদনাভারে আবেগবান, কখনও চঞ্চল। তাই তাঁর কবিতায় একই সাথে অনুরণিত হয় স্মৃতির প্রীতি, আনন্দ-গীতি ও করুণ গাথা। আনন্দ-বেদনার সুমিশ্রণে কবিতার মধ্যে যে শব্দময়তা ধরা দেয়, তা মর্মর ধ্বনি তোলে। সমগ্র কবিতায় কবির মানসভঙ্গি ধ্বনিময় শরীরের দিকে, অন্তরঙ্গ স্রোতে ধাবিত ছন্দের দিকে, স্বপ্নকাতর আবহের দিকে। সর্বোপরি বলা যায়, কবি রহীম শাহ ধ্বনিময় কল্লোলেরই অধিক অভিসারী। রহীম শাহ জীবনের আলোকিত দিকের কথা বলেন, বলেন স্বপ্ন আর সম্ভাবনার কথা।
জোনাকিরা এসে উড়ে
রাতের কপোল জুড়ে
দিয়ে যাবে সাতরঙা টিপ
জোছনার উৎসবে
এই দেশ হবে হবে
যেন এক স্বপ্নের দ্বীপ।
তাঁর প্রকাশভঙ্গি সরল সহজ ও নির্দ্বন্দ্ব। কোথাও কোথাও সাদামাটা মনে হলেও ভাব বা বক্তব্যের কারণে হয়ে ওঠে ইঙ্গিতময় ও তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর কল্পনাবৃত্তিও বাস্তবধর্মী। তিনি স্বপ্ন ছড়িয়ে পাঠককে উদ্দাম-উত্তাল করে তোলেন।
তাই ছুটেছি হাওয়ায় উড়ে হারিয়ে দিক-দিশে,
ওই যেখানে রইল আকাশ নদীর সাথে মিশে?
হতাশা ও কষ্টের ভারে কখনও কখনও তিনি আহত হন, ছাইচাপা ক্ষোভে হন অস্থির। তবু তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় সহমর্ম ও সমবেদনা লাভের শৈশব-অভিলাষ’।

আমি যে এখন অনেক অনেক দূরে
ধরে নিতে পারো রয়েছি অচিনপুরে
এখানে যে নেই সবুজের খাম
কেউ-ই জানে না বকুলের নাম
মানুষের বাড়ি আকাশ ছুঁয়েছে, গাছেরা পড়েছে চাপা
এখানে কেবল স্বপ্ন রয়েছে রাঙা পুস্তকে ছাপা।

রহীম শাহ’র অসামান্য একটি কবিতা ‘কথোপকথন’। পুরো কবিতাই এখানে তুলে ধরতে চাই।

লাটাই:
নীল আকাশের উঠোন তোমার চারণ ভূমি
শুনছ ঘুড়ি! ভীষণ রকম স্বাধীন ভূমি।
ভাগ্য তো নেই তোমার মতো উড়তে পারা
আমরা সবাই ভাগ্য হারা, ভাগ্য হারা!
ঘুড়ি:
যতই আমি উঠি নাকো আকাশ পানে
স্বাধীনতা? নেই যে তোমার সুতোর টানে।
আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে যতই নাচি
তোমার হাতে বন্দি আছি, বন্দি আছি।
খোকা:
তোমরা যতই কাঁদো-কাটো দিনে রাতে
স্বাধীনতা আমার হাতে, আমার হাতে।

লাটাই ঘুড়ি আর খোকার কথোপকথনের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে একটি চিত্র, যে চিত্র বাস্তবতার এবং একই সাথে নির্মমতার। রূপাকাশ্রিত এ কবিতায় যেমন গভীরতা আছে, তেমনি আছে জীবনবোধ। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে ছোটোদের সচেতন করে তোলার প্রয়াস রয়েছে এ কবিতায়।
এই জগতে আকাশ, বাতাস, পাহাড়, নদী, বন, ফুল, পাখি তথা ভূ-প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের নিবিড় আত্মীয়তার সম্পর্ক। এই প্রকৃতি বার বার বিচিত্ররূপে ধরা দিয়েছে রহীম শাহ’র কবিতায়। তিনি ‘সবকিছু আমাদের’ কবিতায় বলেছেন:
এই দেশ এই মাটি
সবুজের পরিপাটি
এই ফুল এই পাখি
রোদ্দুরে মাখামাখি
বাওড়ের নীল জল
কাক-চোখ টলমল
সবকিছু আমাদের।

অন্যদিকে, ‘পাহারাদার’ কবিতায় কবি দুরন্ত কৌতূহলী কিশোরের ইচ্ছের কথাই ব্যক্ত করেছেন। ছোটোরা সতেজ সবুজ ও প্রাণবন্ত মন নিয়ে দিগবিদিগ ছুটে বেড়ায়। লক্ষ্য কেবল অসীমের পানে ছোটা। তিনি লিখলেন:

কিশোর ছুটছে বন থেকে বনে
কত যে স্বপ্ন আঁকা তার মনে
মুক্ত পাখিরা ডানা মেলে দিয়ে স্বাগত জানায় তাকে
পেছনে ফেরার নেই অবকাশ
পাশে পাশে তার মুক্ত বাতাস
মাথার ওপর নিবিড় আকাশ পথের নিশানা আঁকে।
ছলকে ছলকে যাচ্ছে পেরিয়ে
পেছনের সব বাধাকে এড়িয়ে
কিশোর ছুটছে বনে ও পাহাড়ে নেই পিছুটান তার
আলোর ফুলকি ছড়িয়ে ছড়িয়ে
মুক্ত বাতাস বুকে সে ভরিয়ে
পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে কিশোর নির্ভয়ে তোলে ঘাড়।
আজ কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা এলো কিশোর পাহারাদার।

কবি রহীম শাহ প্রচুর ছড়া-কবিতা লিখেছেন। তাঁর কাব্যভাব, রস চেতনা ও ছন্দবোধ অসাধারণ। তাঁর লেখাগুলো ছোটদের যেমন কৌতূহলী করে তোলে, তেমনি সহানুভূতিশীল ও সহমর্মী করতে সচেষ্ট।

সমকালীন সমাজ তাঁর ছড়ার শরীরকে যেভাবে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়; ঠিক তেমনটা কবিতার বেলায় পরিলক্ষিত হয় না। তাই আমাদের এই ভূ-ক্ষ-ের ইতিহাস ও ভাষা যেরকম তাঁর কবিতায় দেখি, সেভাবে দেখিনা নানা উত্থান-পতনের চিত্র, দেখিনা আন্দোলন ও উদ্বেগের শ্বাস-প্রশ্বাস। হয়তো কবি তাঁর দেশ ও জাতির গৌরগাথার সরল ও নিরভিমান উপস্থাপনার মাধ্যমে আগামী প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে চান; নানা দুঃসহ ও ক্লিষ্ট চিত্রের বর্ণনা থেকে সুকৌশলে দূরে থেকে তাদেরও রাখতে চান স্বপ্নময় ও সুন্দর।
প্রত্যেকটি কবিতা শিল্প-সৌকর্যে নিটোল তুলনাহীন হবে- এমন আশা করা অসঙ্গত জেনেও বলতে পারি রহীম শাহ’র অধিকাংশ কবিতায় শব্দ ও ভাষার কুন্টিত লাবন্য উঁকি দেয়; খোলা থাকে সুবি¯তৃত মনের ঝুল-বারান্দা। রূপক, উপমা ও উৎপ্রেক্ষার রেশমি রুমালের ভেতর দিয়ে তিনি তাঁর ভাবনাকে অন্যের মনে সঞ্চার করেন। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ তিনি যতটা সহজ, ততটা অকৃত্রিম। তাঁর কণ্ঠস্বরের সরলতা মন ছুঁয়ে যায়। কখনও কখনও খুব ছোট্ট পরিসরে সাধারণ বর্ণনার মাধ্যমে অসাধারণের হঠাৎ চুমকি বসিয়ে দিতে পারেন, পারেন পাঠককে স্বপ্নাবিষ্ট করে রাখতে। তাই বলতে পারি এ কৃতী লেখক সর্ম্পকে আলী ইমামের মূল্যায়ন যথার্থ : ‘জলজ প্রকৃতি আর অফুরন্ত শ্যামল নিসর্গ আক্রান্ত জনপদের, লোকজ জীবনের এক স্পর্শকাতর তীব্র সংবেদনশীল লেখক রহীম শাহ’।
তাঁর সহজিয়া নির্মোহ ও আবেগী উচ্চারণ, সরল-সত্তার বৈচিত্র্যময় রূপায়ন এবং সর্বোপরি দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ, সবকিছুই তাঁকে করেছে বিশিষ্ট ও প্রিয়।

তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : আগুন ডানার পাখি, বুনো হাঁসের অভিযান, অ্যাডভেঞ্চার হিমছড়ি, চার খঞ্জনার গল্প,
রাতের কপালে জোনাকির টিপ, সবার আগে কুসুম বাগে, দশ দশে ১০০, স্বপ্ন নিয়ে খেলা, আনন্দ রে আনন্দ, নির্বাচিত কিশোর কবিতা, নির্বাচিত ১০০ ছড়া, সব রকম লেখা, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ১০১ কিশোর রচনা প্রভৃতি। লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ স্মৃতি শিশুসাহিত্য পুরস্কারসহ অনেকগুলো পুরস্কার ও সম্মাননা তিনি অর্জন করেন।

Showing all 7 results

Show sidebar