সিরু বাঙালি : মুক্তিযুদ্ধসহ নানা সময়ে যিনি রেখে চলেছেন বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা

সিরু বাঙালি। আমাদের সিরু ভাই। এই মানুষটি একসময় আমার সমস্ত কর্মকা-ে ছিলেন ছায়ার মতো। আমাদের ‘শৈলী প্রকাশনের’ সূচনা থেকে শুরু করে ‘চট্টগ্রাম একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত সকল সাংগঠনিক তৎপরতায় সিরু ভাই ছিলেন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য শক্তি। শৈলীর প্রথম বইয়ের প্রকাশনা শুরু হয় তাঁর বই প্রকাশের মধ্য দিয়ে, ১৯৯৫ সালে। বইয়ের নাম : ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার : ইতিহাসের নিষিদ্ধ সংলাপ’। বলা বাহল্য, সেই সময়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের কথা ভাবাই ছিল অকল্পনীয়। বইটি প্রকাশিত হয় ৩রা নভেম্বর জেলহত্যা দিবসে। এর আগে ১৫ আগস্ট উপলক্ষে ১৯৯৫ সালের ২৬ শে আগস্ট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে আমরা বঙ্গবন্ধু লেখক শিল্পী সম্মিলন পরিষদের উদ্যোগে ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- : বিচার নির্ধারিত হোক ইতিহাসের শিক্ষায়’ শীর্ষক একটি সেমিনারের আয়োজন করি। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বরেণ্য শিক্ষাবিদ প্রফেসর মুস্তাফা নূর উল ইসলাম। মূল প্রবন্ধ লিখেছিলেন প্রাবন্ধিক-কলামিস্ট ও ছড়াশিল্পী অজয় দাশগুপ্ত। সঞ্চালনায় ছিলাম আমি। আলোচনায় অন্যান্যের মধ্যে সিরু বাঙালিও ছিলেন। ওখান থেকেই শৈলীর প্রথম বইয়ের বিষয়টি আমার মাথায় আসে।
বাংলাদেশে প্রথম স্বাধীনতার বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় শৈলী প্রকাশনের উদ্যোগে, ২০০০ সালে। প্রথম স্বাধীনতার বইমেলা উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন সিরু বাঙালি। ২০০১ সালে আমরা চট্টগ্রামের কবি সাহিত্যিক শিল্পী সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করি ‘চট্টগ্রাম একাডেমি’। তাতে চেয়ারম্যান হিসেবে সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রফেসর অনুপম সেন এবং পরিচালক
হিসেবে ছিলেন সিরু বাঙালি। এভাবেই সিরু ভাই আমার সমস্ত কর্মকা-ের সঙ্গী হিসেবে যুক্ত থেকেছেন।

আমি যতদূর দেখেছি, সিরু বাঙালি একজন প্রতিবাদী চেতনার মানুষ। তাঁর লেখক সত্তাও সেই সূত্রেই বিকশিত। পাকিস্তানিদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন প্রথম গ্রেফতার হয়েছিলেন ঢাকায়। কারাভোগ করেন ৬৯ দিন। জেল থেকে বেরিয়েই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নেমে যান সংগ্রামে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা কমান্ডার হিসেবে অসামান্য বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন সংগ্রামী এই মানুষটি। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ : ৪৫টি। লেখালেখি ১৯৬৮ সাল থেকে শুরু হলেও ১৯৭২ সালেই তাঁর আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ঘটে। রাজনৈতিক চেতনাই তাঁর লেখার উপজীব্য। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে তাই লিখেছেন ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার : ইতিহাসের নিষিদ্ধ সংলাপ’, ‘সেনাপতির মুক্তিযুদ্ধ ছিনতাই’, ‘মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে মেজর জিয়ার পলায়ন : প্রামাণ্য দলিল’, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : বহির্বিশ্বে শত্রু-মিত্র’ ও ‘আমার যুদ্ধ আমার একাত্তর’। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ওই গ্রন্থগুলো দেশে-বিদেশে তুলেছে ব্যাপক আলোড়ন। তাঁর মনোযোগ শিশুসাহিত্যের দিকেও। আমাদের কাছ থেকে ছোটোদের জন্য লেখালেখি শুরু করার তাগিদ পেয়ে তিনি লিখেছেন প্রচুর লেখা। ‘আব্বুর জন্য যুদ্ধ’ তাঁর প্রথম ছোটোদের বই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কোমলমতি শিশুদের মাঝে ছড়িয়ে দেবার মানসে তিনি এখন নিরলসভাবে লিখে চলেছেন শিশুতোষ গল্প-উপন্যাস। প্রকাশিত হয়েছে ৬টি কিশোর উপন্যাস। ১৫টি কিশোর গল্পগ্রন্থ। ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর উপন্যাসসমগ্র’, ‘ছোটদের গল্পসমগ্র’ ও নির্বাচিত উপন্যাস ‘একাত্তরের সূর্যসেনা’ উল্লেখযোগ্য।
সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, শীর্ষ রাজাকার সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান সাক্ষী হিসেবে জাতীয় দায়িত্ব পালনে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি, স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতির সাথে আমরাও গর্বিত এই মহান বীরের জন্য।

Showing all 7 results

Show sidebar